জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শহীদ আবু সাঈদ গেইটের সামনে স্থাপিত স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পে তথ্যগত অসঙ্গতি থাকায় দেড় মাস ধরে সেটিকে লাল কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। এত দিন পার হওয়ার পরও তথ্যের অসঙ্গতি সংশোধনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ এখনও লক্ষ্য করা যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
চলতি বছরের ১৬ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) উদ্যোগে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অর্থায়নে জুলাই আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের আত্মত্যাগ স্মরণার্থে বিশ্ববিদ্যালয়টির এক নম্বর ফটকের সামনে মেমোরি স্ট্যাম্পটি স্থাপন করা হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়।
সাঈদের জন্মসাল ও শাহাদাতের বিবরণ নিয়ে অসঙ্গতি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা জুলাই আন্দোলনে ছাত্রজনতার আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে চলতি বছরের শুরুতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকের সামনে আবু সাঈদের শাহাদাত বরণের স্থানে শহীদ আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
পরে এই বছরের ১৬ জুলাই সকালে শহীদ দিবস ও আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ অন্য অতিথিদের আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পের ওপর থাকা লাল মোড়ক সরিয়ে উদ্বোধন করার কথা থাকলেও, সেটি না করে তারা আবু সাঈদ গেইটের ভেতরে স্থাপিত গেইট ও যাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরে শহীদ আবু সাঈদের পিতা মকবুল হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফয়েজ আহামেদসহ আরও কয়েকজন অতিথি লাল কাপড়ের মোড়ক সরিয়ে মেমোরি স্ট্যাম্পটি উন্মোচন করেন।
পরে স্ট্যাম্পটির স্মরণ বার্তায় শহীদ আবু সাঈদের ভুল জন্মসাল, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁকে উল্লেখ না করাসহ তাঁর শাহাদাতের অসঙ্গতিপূর্ণ বিবরণ সামনে এলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ওঠে প্রতিবাদের ঝড়।
যা লেখা ছিল স্মরণ বার্তায়
শহীদ আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পটির স্মরণ বার্তায় লেখা ছিল: রংপুরের সন্তান শহীদ আবু সাঈদ। জালেম ও জুলুমের বিরুদ্ধে যার শির ছিল চির উন্নত। তিনি বলতেন, “প্রয়োজনে শহীদ হব, তবু মাথা নোয়াব না।” ১৬ জুলাই আসমানের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে শাহাদাত বরণ করলেন। এরপরই সারা বাংলাদেশ জেগে ওঠে অনন্ত বিপ্লবের ওয়াদা নিয়ে।
এ ছাড়া, সেখানে প্রকৃত জন্মতারিখ ২০০০ সালের ১০ ডিসেম্বরের বদলে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারিকে আবু সাঈদের জন্মদিবস হিসেবে উল্লেখ করা হয় বলে অভিযোগ তোলেন শিক্ষার্থীরা।
১৮ জুলাই মুড়ে দেওয়া হয় লাল কাপড়ে
স্থাপনের দু’দিন পর ১৮ জুলাই অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য সংবলিত ওই স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পটি লাল কাপড় দিয়ে মুড়ে দেন শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সে সময় সেখানে উপস্থিত সাবেক সমন্বয়ক মো. শামসুর রহমান সুমন, মো. আরমান হোসেন ও আবু সাঈদের ছেলেবেলার বন্ধু মাহিদ হাসানসহ সকলে অবিলম্বে স্ট্যাম্পটির স্মরণ বার্তা সংশোধনের দাবি জানান। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ হতে সেটি সংশোধনে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর দেড় মাস অতিবাহিত হলেও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি এখনও।
আগস্টে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এলেও জানাননি সিদ্ধান্ত
এ দিকে, গত ২০ আগস্ট একদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে রংপুরে আসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। সে দিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে পার্কের মোড়ে (অধুনা শহীদ আবু সাঈদ চত্বর) নির্মিত শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান৷ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় স্মরণ করেন আবু সাঈদের আত্মত্যাগের কথাও।
কিন্তু ভুল তথ্য সংবলিত আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পের স্মরণ বার্তা সংশোধনের বিষয়ে সে সময়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি তিনি। ফলে সেটি এখনও লাল কাপড়ে মোড়া অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জানান, আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার ঘটনা এবং তাঁর জীবনের সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলেও স্ট্যাম্পটিতে এতগুলো তথ্যের অসঙ্গতি থাকা আদতে ইতিহাস বিকৃত করার একটি ঘৃণ্য ‘পাঁয়তারা’-র শামিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অনুল্লেখ করার বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
পাশাপাশি, মেমোরি স্ট্যাম্পটিতে আবু সাঈদের শাহাদাতের ঘটনাকে ‘পুলিশি হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ না করার কারণেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দিকে তোপ দাগেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এমতাবস্থায়, দেড় মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও স্ট্যাম্পটির বার্তা সংশোধন না করার বিষয়টি নিয়ে এক রকম হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা।
এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মো. শামসুর রহমান সুমন বলেন, “মেমোরি স্ট্যাম্পের লেখায় অসঙ্গতি দেখার পর আমরা কয়েকজন মিলে (গত) ১৮ জুলাই (সেটি) লাল কাপড়ে ঢেকে দেই। আমাদের মনে হয়েছিলো এমন লেখা ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর। সে সময়, তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেটি সংশোধন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন প্রায় এক মাস (পার) হয়ে গেছে।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখনও সেটি লাল কাপড়েই ঢাকা রয়েছে। জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মেমোরি স্ট্যাম্পের এই যদি হয় অবস্থা, তবে অন্যান্য বিষয়ে বলার আর কিছু থাকে না। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কেউ অবহেলা করে থাকলে, তাদেরও উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান তিনি।
আরেক সাবেক সমন্বয়ক ও গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আরমান হোসেন অভিযোগ করেন, গত ১৬ জুলাই শহীদ দিবসে তড়িঘড়ি করে স্ট্রিট স্ট্যাম্পটি বসানোর আগে আমাদের থেকে কোনো তথ্য জানতে চাওয়া হয়নি। ফলে আবু সাঈদের জন্মতারিখ ভুল হয় এবং বর্ণনামূলক লেখাতেও জুলাইয়ের চেতনাকে অবজ্ঞা করা হয়।
হতাশা ব্যক্ত করে আরমান আরও বলেন, আমরা বিষয়টি জানার পরপরই প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে স্ট্যাম্পটি লাল কাপড়ে ঢেকে দেই এবং সংশ্লিষ্ট মহলকে অবগত করি। তারা দ্রুত সংশোধন করার আশ্বাস দেয়। তবে এত দিনেও তা না হওয়ায়, আমরা খুবই হতাশ। অতি দ্রুত বিষয়টির সুরাহা করতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানান তিনি।
স্ট্যাম্প স্থাপনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা নেই, দাবি প্রশাসনের
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মো. হারুন-অর-রশিদ জানান, শহীদ আবু সাঈদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পটি মূলত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে। রংপুর জেলা প্রশাসনও বিষয়টি দেখভাল করছে। এলজিইডিরও সংশ্লিষ্টতা আছে।
কবে নাগাদ স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পটির বার্তা সংশোধন করা হবে সে বিষয়ে বেরোবি রেজিস্ট্রার বলেন, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়, এলজিইডি, জেলা প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সমন্বিত পদক্ষেপে এটি স্থাপিত হওয়ায় তারাই বলতে পারবেন—কবে এটি সংশোধন করা হবে। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সার্বিকভাবে, বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সালের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ফটকস্থিত ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে বন্দুকের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়ালে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে শাহাদাত বরণ করেন তিনি।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামের বাসিন্দা মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই আন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি।