1. info@aynatv.info : বার্তা বিভাগ : বার্তা বিভাগ
  2. admin@aynatv.info : admin :
শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

ইন্দোনেশিয়ায় বৈষম্যবিরোধী চেতনার স্ফূরণ, ভবিষ্যৎ কী?

Reporter Name
  • প্রকাশের সময় : সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

|| রুশাইদ আহমেদ ||লাগামহীন সরকারি ব্যয়, রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণিকে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতিসহ রাষ্ট্রের দুর্নীতি ও অনিয়মে জর্জরিত নানা মৌলিক ব্যবস্থা ও নীতিমালার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ জনগণ। এরই মধ্যে দেশটির অর্থমন্ত্রী শ্রী মুলিয়ানি ইন্দ্রাবতীর বাড়িতে লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করেছে জনতা। জনরোষের আগুনে পুড়ে গেছে দেশটির দক্ষিণ সুলাওয়েসি, পশ্চিম নেসা তেঙ্গারা, মধ্য ও পশ্চিম জাভার প্রাদেশিক সংসদ ভবনও। অথচ এই অঞ্চলগুলোতেই ক্ষমতাসীন গেরিন্দ্রা পার্টির বৃহৎ জনসমর্থন রয়েছে।গত বছরের অক্টোবরে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জয়লাভ করেন দেশটির সাবেক জেনারেল ও কট্টর জাতীয়তাবাদী দল গেরিন্দ্রা পার্টির নেতা প্রবোও সুবিয়ান্তো। এর আগে, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিন দফা ব্যর্থ হন বিংশ শতাব্দীতে তিন দশক ধরে দেশটির ক্ষমতায় থাকা কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর জামাতা সুবিয়ান্তো।কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের এক বছর পার হওয়ার আগেই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লো তাঁর সরকার। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরজয়ের পর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে “সকল ইন্দোনেশীয়ের ন্যায়সঙ্গত প্রেসিডেন্ট” হিসেবে ঘোষণা করা সুবিয়ান্তোর বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা করে চলতি বছরের ২৫ আগস্ট থেকে দেশটির রাজধানী জাকার্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বিক্ষোভে নামেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা।মূলত, জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া, রাজনৈতিক অভিজাত ব্যক্তিদের অত্যাধিক মাত্রায় অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান, সাধারণ মানুষের গড় আয়ের তুলনায় সংসদ সদস্যদের ৩০ গুণ বেশি বেতন নির্ধারণ এবং বিতর্কিত গৃহনির্মাণ ভাতা বিল পাসের জেরে এই অসন্তোষ দেখা দেয়। কিন্তু এরপরও সুবিয়ান্তো সরকার নিজেদের ভুল সংশোধনের দিকে পা না বাড়িয়ে বিক্ষোভকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম’ আখ্যা দিয়ে বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।গত ২৮ আগস্ট জাকার্তায় বিক্ষোভরতদের সঙ্গে থাকা রাইড শেয়ারিং চালক আফফান কুনরিওয়ান পুলিশের গাড়িচাপায় প্রাণ হারান। এতে আন্দোলনকারীরা স্বভাবতই আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পরে দেশটির চারটি প্রাদেশিক সংসদ ভবন, সংসদ সদস্যদের বাড়িঘর এবং কিছু সরকারি স্থাপনায় তাণ্ডব চালান তাঁরা। বৈষম্য নিরসন ও সংস্কারের দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অযাচিত বলপ্রয়োগের বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন।কেননা, যখন কোনো দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় আরোহণের আগে নিজেকে “সকলের নেতা বা প্রেসিডেন্ট” হিসেবে আখ্যা দিয়ে মসনদে বসার পর অভিজাত শ্রেণি এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন, তা তার প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ বলেই জনসাধারণের সামনে প্রস্ফুটিত হয়। তাঁর সকল বক্তব্যও তখন পরিণত হয় স্রেফ জনতুষ্টিবাদী ফাঁকা বুলিতে৷ আর এসবের প্রতিবাদে জনসাধারণ যখন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, তখন অযাচিতভাবে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া মানেই হলো মানবাধিকারের গুরুতর ব্যত্যয়।অবশ্য সুবিয়ান্তোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় নিজের শ্বশুর ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর ক্ষমতার হাত সুসংহত রাখতে সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে তিনি ১৯৮৩ সালে সুহার্তোকে উৎখাতের সন্দেহজনক পরিকল্পনাকারী বেনি মুরদানিকে অপহরণ করেন বলে উল্লেখ করেন সুহার্তোর পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট হওয়া বাশারুদ্দিন ইউসুফ হাবিবির সামরিক উপদেষ্টা সিনতোং পাঞ্জাইতান। তবে সুবিয়ান্তো পাঞ্জাইতানের এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন সবসময়।পূর্ব তিমুরে কয়েক দশকব্যাপী ইন্দোনেশীয় সামরিক আগ্রাসন চলাকালে ক্রারাস গণহত্যা সংঘটনে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, ১৯৯৮ সালে সুহার্তোবিরোধী আন্দোলনের সময় নয় অ্যাক্টিভিস্টকে অপহরণ করেন তিনি। এ কারণেই সুহার্তোর পদত্যাগের পর বাশারুদ্দিন ইউসুফ হাবিবি সরকারের আমলে তাঁকে সামরিক বাহিনী থেকে সসম্মানে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানো হয়।ফলে এই বিষয়গুলো নিয়ে ২০০৯ সালেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সুবিয়ান্তো যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।এতদসত্ত্বেও, সকল প্রশ্নকে উৎরে অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হওয়া ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জয়লাভ করে এখন দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সুবিয়ান্তো। তবে ৭৩ বছর বয়সী সুবিয়ান্তো সম্ভবত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন বলে মনে হয় না।১৯৯৮ সালে ছাত্র আন্দোলনের জেরে ইন্দোনেশিয়ার একনায়ক সুহার্তোর ক্ষমতাচ্যুত হওয়া কিংবা নিজের চাকরিচ্যুত হওয়ার আলাপ বাদ দিলেও নিকট অতীতে তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাস আগেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের মানুষের ভেতর বৈষম্য সৃষ্টিকারী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের স্ফূরণের মতো জ্বলন্ত উদাহরণ তার ভেতর কোনো বদল আনতে পারেনি। এ কারণেই তিনি স্বেচ্ছাচারী নীতিমালা প্রণয়ন করে অভিজাত শ্রেণি এবং নিজের কাছের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে সঙ্গে নিয়ে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার প্রসারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন।এমতাবস্থায়, বৈষম্যমূলক কর্তৃত্ববাদী সিদ্ধান্তসমূহের বিরোধিতা করে ইন্দোনেশিয়ার ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানালেও সুবিয়ান্তোর টনক নড়েনি। বরং পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁর বলপ্রয়োগের কৌশল যেন আরও ঘোলাটে করে তুলেছে সবকিছু।ইন্দোনেশীয় সরকারের বরাতে এখন পর্যন্ত এ আন্দোলনে কমপক্ষে ১০ জনের প্রাণহানির খবর জানিয়েছে বিবিসি। পাশাপাশি, মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা কমিশন ফর দ্য ডিসঅ্যাপিয়ার্ড অ্যান্ড ভিকটিমস অব ভায়োলেন্সের (কন্ট্রাএস) মতে, আন্দোলন শুরুর থেকে ইন্দোনেশিয়ার প্রশাসনিক শহর বান্দুং, ডেপোক, মধ্য জাকার্তা, পূর্ব জাকার্তা ও উত্তর জাকার্তায় অন্তত ২০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ১২০০ আন্দোলনকারী। তাই আন্দোলন দমানোর নামে যদি আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে তা নির্ঘাৎ সুবিয়ান্তো সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নিয়ামক হয়ে উঠবে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।আল-জাজিরার প্রতিবেদন মোতাবেক, গত ২ সেপ্টেম্বরও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব বান্দুং (ইউএনআইএসবিএ) ও নিকটবর্তী পাসুন্দান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ফলে ৩ সেপ্টেম্বর জাকার্তার সংসদ ভবনের কাছে ইন্দোনেশিয়ান উইমেন্স অ্যালায়েন্স এবং নানা সংগঠনের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বন্ধ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানোর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুবিয়ান্তো দেশটির জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে সরকারি ব্যয় কমানো এবং সংসদ সদস্যদের অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়ে ইতিমধ্যে নমনীয় হয়েছেন। তবে তাঁর দেশের জনগণ এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তাঁরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার বিচার চান। সংস্কার চান গোটা শাসনকাঠামোর।এই পরিস্থিতিতে, সুবিয়ান্তো দেশের স্থিতিশীলতা পুনর্স্থাপনে পারস্পারিক সমঝোতা ও শান্তি প্রক্রিয়াকে বেছে নিবেন, নাকি শ্বশুর সুহার্তোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে টালমাটাল আগামীর দিকে এগিয়ে যাবেন—সেটিই এখন দেখার বিষয়।•

রুশাইদ আহমেদ, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। নিয়মিত ভূরাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, যোগাযোগ নিয়ে লিখে থাকেন। মেইল: rusaidahmed02@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

Comments are closed.

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
All rights reserved © 2024