বাংলা চলচ্চিত্র বা ঢালিউড অঙ্গনে এক সময় শাকিব খানের অবস্থান ছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নানা নেতিবাচক কথা ও কর্মকান্ড যে এখন দর্শক আর সহজে গ্রহণ করছে না, তা স্পষ্ট। একটা সময় ছিল যখন তার ছবি মানেই ছিল প্রেক্ষাগৃহে ভিড়। কিন্তু এখন সেই আকর্ষণ যেন অনেকটাই ম্লান। আমি মনে করি, একজন শিল্পীর কাছে দর্শক সবসময় বিনোদন ও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে। যখন সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়।
আমি বলতে চাই, এই নেতিবাচকতার পেছনে শুধু শিল্পীর ব্যক্তিগত দায়ই নয়, কতিপয় প্রযোজক ও পরিচালকের নোংরা ব্যবসাও অনেকাংশে দায়ী। তারা শাকিব খানের তারকাখ্যাতিকে ব্যবহার করে এক ধরনের গতানুগতিক, মানহীন বা দ্রুত লাভের আশায় সিনেমা তৈরি করেন। এই ধরনের ব্যবসা মূলত চলচ্চিত্রের শিল্পমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি অনেকটা ভেজাল পণ্যের মতো—চটকদার মোড়কে বিক্রি হয়, কিন্তু ভেতরের জিনিসটি অন্তঃসারশূন্য। ফলস্বরূপ, শিল্পী ও শিল্পের প্রতি দর্শকের বিশ্বাসে চিড় ধরে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। আমি মনে করি, মহানায়ক মান্নার মৃত্যুই শাকিবকে আলাদীনের চেরাগ হাতে তুলে দেয়। মান্না ছিলেন ঢালিউডের একজন বিশাল তারকা এবং বক্স-অফিসের একচ্ছত্র অধিপতি। তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে যে শুন্যতা তৈরী হয়, সেই শূন্য স্থানটিতে প্রযোজক ও পরিচালকদের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠেন শাকিব খান। এই সময়ে তিনি কার্যত একচেটিয়া স্থান পান এবং রাতারাতি তার গুরুত্ব ও পারিশ্রমিক বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু সেই ‘চেরাগ’ হাতে পাওয়ার পর তিনি তার সম্ভাবনাকে মানসম্পন্ন কাজ দিয়ে কতটা কাজে লাগাতে পেরেছেন, তা প্রশ্নের সম্মুখীন।
আমরা যদি বিগত বছরগুলোর দিকে তাকাই, তবে আমি অনুভব করি যে শাকিব খান মূলত ঢালিউডকে ভালো কিছু দিতে পারেননি। ভালো কিছু বলতে আমি শুধু বক্স-অফিস সাফল্যকে বোঝাচ্ছি না, বরং এমন চলচ্চিত্রকে বোঝাচ্ছি যা শিল্পের ইতিহাসে স্থান করে নেবে, যা নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হবে, বা যা আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, বা আমাদের দেশের তারেক মাসুদের মতো কিংবদন্তিরা চলচ্চিত্রকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তাঁদের কাজগুলো শুধু বিনোদন ছিল না, ছিল সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। শাকিব খানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই ধরনের ‘ঐতিহাসিক অবদান’ এর সংখ্যা খুবই কম।
চলচ্চিত্র শুধু একটি শিল্প নয়, এটি একটি সমাজের দর্পণ। এখানে যখন ব্যক্তিগত নেতিবাচকতা আর মানহীন ব্যবসায়িক কৌশল প্রাধান্য পায়, তখন পুরো শিল্পটাই ভুগতে শুরু করে। আমি মনে করি, শাকিব খান বা অন্য যে কোনো তারকার উচিত—তাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তাকে শুধুমাত্র ভালো ও মানসম্পন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করা, যা ঢালিউডকে সত্যিই এগিয়ে নিয়ে যাবে। তা না হলে, একসময় হয়তো তারা ইতিহাস হয়ে থাকবেন, কিন্তু সেই ইতিহাস হবে মলিন, উজ্জ্বল নয়।
-লেখক: কবি, সাংবাদিক, আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পী