মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় নাজেহাল ঢাকাসহ দেশের মানুষ। গত বছরের তুলনায় এবার এ রোগের প্রকোপ কয়েক গুণ বেশি। প্রতি মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মৃত্যুও হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাইরাল জ্বর। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়া এই অসুখে দেশ কার্যত কাবু। এ অবস্থায় মশক নিধন ছাড়া সমাধান দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশাবাহিত এই রোগ প্রতিরোধে মূল কাজ হলো মশক নিধন। পাশাপাশি অসুস্থদের সময়মতো চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। কারণ মৃতদের বেশিরভাগই শেষ সময়ে হাসপাতালে গেছেন, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। গত কয়েক মাসে এটি দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আক্রান্ত ছিলেন ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে ৬৪৪, জুন ৭৯৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ এবং ডিসেম্বরে ৯ হাজার ৭৪৫ জনে।
এডিস মশা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক। তাই মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বছরের শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করলেও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম হয়নি। ফলে শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে ১ হাজার ৭৭৩, জুনে ৫ হাজার ৯৫১, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ এবং চলতি সেপ্টেম্বরে এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি জন।
একই সঙ্গে চিকুনগুনিয়া ও ভাইরাল জ্বরের হিসাব নেই। হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রায় প্রতিটি বাসাবাড়িতেই জ্বরে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। বেশি ভোগাচ্ছে গিঁটে ব্যথা ও অস্বাভাবিক রকম শারীরিক দুর্বলতা।
চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন। প্রতি বছরের মতো এবারও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর মারা যান জুনে ৮ জন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ৩০ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৮৭ জন। সে সময়ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা সেপ্টেম্বরে সর্বাধিক ছিল।
এমতাবস্থায় মশক নিধনকেই প্রথম ও জরুরি কাজ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেহেতু এটি মশাবাহিত রোগ, তাই কার্যকর মশক নিধন ছাড়া বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়েও সচেতনতা অপরিহার্য। আর আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করা যাবে না।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের শত্রু সবাই চিনি— মশা। একসময় শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি আর জমে থাকা পানিই মশার বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। তাই জমে থাকা পানি দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে— হোক তা ফ্রিজের নিচে, এসির পাশে, ফুলের টব, ছাদ বা রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত টায়ার। মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ যুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে নামতে হবে। মশক নিধন ছাড়া ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া বা জিকার মতো রোগ ঠেকানো সম্ভব নয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এডিস মশা একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক। তাই মশা নিয়ন্ত্রণই এখন সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। বছরের শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করলেও কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম হয়নি। এর ফলে শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কার্যকর মশা নিধন না করলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকি আরও ভয়াবহ হবে।’
ডেঙ্গুর বড় সমস্যা হলো— রোগীরা অনেক হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর
রাজধানীর শ্যামলী ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, ‘আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। থেমে থেমে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় এডিস মশার প্রজনন হয়, যেখান থেকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকার মতো মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রতিটি বাড়ি, অফিস ও আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, জমে থাকা পানি সরানো এবং নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। মশার বংশবিস্তার রোধই আমাদের জীবন বাঁচানোর প্রধান উপায়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘ডেঙ্গুর বড় সমস্যা হলো— রোগীরা অনেক দেরি করে হাসপাতালে আসেন। তখন জটিলতা বেড়ে যায় ও চিকিৎসা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। জনগণকে সচেতন করা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই এ সংক্রামক রোগ মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘ডেঙ্গু কোনো জটিল রোগ নয়। সমস্যা হচ্ছে রোগীরা জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিচ্ছেন না। দেরিতে হাসপাতালে আসায় তাদের অবস্থা গুরুতর হয়ে যাচ্ছে। বড় হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ রয়েছে, কোথাও ঘাটতির খবর পাওয়া যায়নি।’
রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ সব সময় বেশি থাকে। প্রতি বছর প্রশ্ন ওঠে মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন মশক নিধনই এসব রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন আমরা সেগুলোর প্রতিপালন করছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি জমতে না দেওয়া, মশার ওষুধ ছিটানো সবই করছি। জনসাধারণকে সচেতন করছি। তরুণদের মাঠে নামিয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নামিয়ে দিয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার আমরা সবই করছি। আমরা আমাদের পদক্ষেপের সুফলও পাচ্ছি। আপনি দেখে থাকবেন, আমাদের শহরে রোগীর সংখ্যা কম।’